গল্প- নির্জন নদীতীর, নীল সন্ধ্যা, ভালোবাসা

নির্জন নদীতীর, নীল সন্ধ্যা, ভালোবাসা
-সুনির্মল বসু

 

 

কথা হচ্ছিল, নদীর কিনারে জেটির পাশে দাঁড়িয়ে,দুপাড়ে তখন সাঁঝ বাতি জ্বলে উঠেছে। নদীর ওপর শান্ত চাঁদের আলো। দু একটা নৌকো ভেসে যাচ্ছিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, মাঝিদের জলজ সংসার।
কতক্ষণ এসেছো?
আধঘন্টা হবে।
সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল।
কেন?
আগের ট্রেনটা পাইনি।
অফিসের কি খবর?
কাজের প্রেসার আছে।
দুজনেই চুপ।
তোমার লেখালেখির কি খবর?
লিখছি। কিছু একটা খুঁজছি। যেখানে পৌঁছবার কথা, সেই জায়গাটা আজও খুঁজে পাই নি।
বুঝতে পারলাম না।
অতৃপ্তি। ভালো লিখতে না পারলে, আমার কষ্ট হয়।
লোকে তো তোমার লেখার খুব প্রশংসা করে।
তাই নাকি!
হ্যাঁ তো।
আমি নিজের লেখা নিয়ে খুশি নই। অথচ, খুশি হতে পারলে, কি ভালো যে লাগতো।
লেখায় এত নতুন নতুন ভাবনা তোমার আসে কি করে?
আমার ব্যর্থ অতীত, সেদিনের অপমান, এত কান্না,
যা কাউকে কখনো বলা হলো না, সেগুলোই লিখি।
পরাজয়ের কথা লিখে কি লাভ?
জানিনা, বলতে পারব না।
সেদিন যারা জিতেছিল, তারা কি তোমার বর্তমান অবস্থার কথা জানে।
তা কি করে বলবো! তবে এটা ঠিক যে,
কি?
তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
কেন?
সেদিন ওরা আমায় অপমান না করলে, আমি হয়তো কখনো কলম ধরতাম না।
তুমি কি স্বাতীর কথা বলছো?
সে আমার অন্ধ অতীত। মনে করতে চাই না সেসব।
তবু কাউকে কাউকে তো বলতেই হয়। না বললে বাঁচা যায় না।
জানি। ও তখন বেটার খুঁজে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারিনি। সাত বছর ধরে আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে, হঠাৎ একদিন আমার হাতে প্রজাপতি আঁকা বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিল।
তারপর?
অগ্নিসাক্ষী করে যখন অভিনব চৌধুরীর সঙ্গে ওর বিয়ে হচ্ছিল, আমি সেই আগুনে আমার ভালোবাসাকে পুড়ে যেতে দেখেছিলাম। সেই থেকে ভালোবাসা আমার কাছে জলাতঙ্ক। আমার জাহাজে দাউ দাউ আগুন।
তোমার লেখায় তাই বারবার ভালোবাসার মধ্যে কান্না ফুটে ওঠে।
হয়তো হবে।
নিজেকে পুড়িয়ে তবু কেন তুমি ধূপের গন্ধ ছড়াও?
বলতে ইচ্ছে করে। না বলে নিজে সুস্থ থাকতে পারি না। তাই ক্রমাগত নিজেকে খুঁড়ে চলি। আমি বাইরে গল্প খুঁজি না। আমার মধ্যে, আমার চারপাশের মধ্যে, আমার অভাবের দিনগুলোর অতীতে গল্প খুঁজি।
একটা কথা বলবো?
বলো।
ওই আঘাতগুলো না পেলে, আজ তুমি লেখক হতে পারতে না।
যারা ভালোবাসার কথা বলে মিথ্যা নাটক করে একদিন স্বপ্নের ভালোবাসার বাড়িটা ভেঙে দিয়ে যায়, তাদের আমি মানুষ মনে করি না।
কি বলছো তুমি?
ঠিকই বলছি। ভালোবাসা খুন করা আর মানুষ খুন করার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য দেখি না।
শুনেছি, আজকাল স্বাতী নাকি তোমার লেখার অনুরাগী পাঠিকা। আমায় বলছিল, একদিন তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
কিন্তু আমি ভাঙা কাঁচের আয়নায় মুখ দেখি না। আমার কাছে এলেও, ওকে ফিরে যেতে হবে।
মানুষকে ক্ষমা করতে শেখো।
কেন ক্ষমা? কিসের জন্য ক্ষমা?
ভুলে যাও।
কেমন করে ভুলি? কত বছর হয়ে গেল, পথের মোড়ে কাঠফাটা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে আছি কতকাল।
আমার জন্য কোন ছায়াময় বৃক্ষ নেই। কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই।
তুমি কি আমার কথা একবারও ভাববে না?
কি বলতে চাইছো তুমি?
আমার বাবা শান্তিনিকেতনে প্রফেসর ছিলেন। উনি ছেলেবেলায় আমাকে বলতেন, আমার নাকি খুব
নাক উঁচু। সবাইকে পছন্দ হয় না, সব জায়গা পছন্দ হয় না।
তাহলে?
কিন্তু যেদিন থেকে তোমার লেখা পড়তে শুরু করলাম, সেদিন থেকে মানুষটাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছি। কবে কখন কিভাবে এসব হলো, নিজেও বুঝতে পারিনি।
মোনালিসা, তুমি দেখি, সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতার মতো করে কথা বলছো!
কি?
সুনীলদা লিখেছেন, ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার,
যেন মায়াপাশ।
শোনো অগ্নিভ, এত বড় বিরাট পৃথিবীতে ভালোবাসা ঠিক কোথাও আছেই আছে। শুধু খুঁজে নিতে হয়।
তাই কি?
ভালোবাসা নিয়ে স্বাতী যেটা করেছে, জেনে নাও, সে কি সত্যিই সুখে আছে?
কি বলতে চাইছো তুমি?
অন্যকে ঠকিয়ে বড়লোক বাড়ির বউ হওয়া যায়, সত্যিকারের ভালোবাসা তো অন্য পৃথিবীর গল্প বলে।
কি সুন্দর করে বললে!
অনেক রাত হল। নতুন শীত এসেছে।
তোমার শীত করছে, মোনালিসা?
নাহ। আমরা কি আবার নতুন করে পথ চলা শুরু করতে পারিনা?
আমাকে একটু একলা থাকতে দাও। ভাঙ্গা এ মন যদি কোনদিন সাহারা মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে ওয়েসিসের সন্ধান করে, সেদিন আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো। তুমি কি অপেক্ষা করতে পারবে?
পারবো পারবো।
ওরা তখন বাড়িতে ফিরছে। স্মৃতিতে ফিরছে। হয়তো ভালোবাসাতেও ফিরছে।

জীবন পথের কিনারায় ভালোবাসার একটা ঘর কবে থেকে এভাবেই খুঁজে যাচ্ছে মানুষ।

Loading

Leave A Comment